দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা হয়েছে। জলাবদ্ধতা, যোগাযোগ বন্ধ হয়ে বিপর্যস্ত অসংখ্য মানুষের জীবন। এমন অবস্থায় উপদ্রব বেড়েছে বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপারের। বিষধর এই সাপটির দেখা মিলছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
গত এক দশকে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত হন ২৩৫ জন, এর মধ্যে মারা যান ৫৯ জন। গত বছরই এই সাপের কামড়ে মারা যান ৫০ জন।
গবেষকদের মতে, বর্ষার সময় সাপ ডাঙ্গায় বা শুকনো জায়গায় বসবাস করে বা করতে চায়। বর্ষায় চারদিকে পানি থাকায় বিষধর সাপও শুষ্ক ও উঁচুস্থানের সন্ধানে মানুষের ঘরে ঢুকে পড়ে।
এ ছাড়া রাস্তা, জমির আইল, কবরস্থান, কাঠের স্ত‚প, খড়ের গাদাসহ যেকোনো জায়গায়ই সাপ আসতে পারে। অবস্থানের সময় মানুষকে দেখলে সাপ ভয় পেয়ে মানুষকে কামড় দেয়। সাপের দংশনের ঘটনা গ্রামাঞ্চলে বা কৃষিসংশ্লিষ্ট এলাকায় বেশি হয়।
বাংলাদেশে মোটামুটি ৮০টি প্রজাতির সাপ রয়েছে।
এর বেশির ভাগই নির্বিষ। তবে সাত থেকে আট প্রজাতির অত্যন্ত বিষধর। এই সাপগুলোর কামড়েই মানুষের মৃত্যু বেশি হয়। তবে বাংলাদেশে যতজন সাপের কামড়ে মারা যায়, তার চার গুণ মানুষের নানা রকম অঙ্গহানি ঘটে, কেউ শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান, কেউ কেউ দীর্ঘদিন আতঙ্কে ভোগেন।
দেশে একসময় বিলুপ্ত বলা হলেও দেশজুড়ে এখন চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে রাসেলস ভাইপার।
বরেন্দ্র অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও সাপটির রাজত্ব এখন দেশের অন্তত ২৫টি জেলায়। বিষধর এই সাপটি পৌঁছে গেছে চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি আনাগোনা মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুরসহ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার অববাহিকায়। সাপটির ছোবলে চলতি বছর এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে অন্তত ১০ জন, যাদের অধিকাংশই কৃষক এবং জেলে। রাজধানী ঢাকার পাশের জেলা মানিকগঞ্জে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে গত তিন মাসে মারা গেছে পাঁচজন।
বিষধর সাপ হিসেবে পৃথিবীতে রাসেলস ভাইপারের অবস্থান পঞ্চম হলেও হিংস্রতা এবং আক্রমণের দিক থেকে এর অবস্থান প্রথম। আক্রমণের ক্ষেত্রে এই সাপ এতটাই ক্ষিপ্র যে ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।
বিষধর সাপের দংশনের পর দ্রæত ওষুধ বা অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের মাধ্যমে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে। জেলা শহর, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং সদর হাসপাতালে এই অ্যান্টিভেনম থাকে। বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়। সাপের কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার পর কিছু পদক্ষেপ নিলে রোগীর জীবন বাঁচানো সহজ হয়। কিছু সাবধানতা অবলম্বনে এড়ানো যায় সাপের কামড়।
অনেকেই সাপের কামড়ের শিকার হয়ে ওঝার শরণাপন্ন হন। তবে এতে বিশেষ কোনো লাভ হয় না, বরং ক্ষতিই বেশি হয়। সাপের কামড়ের শিকার হলে ওঝার কাছে যাওয়া যাবে না বলে পরামর্শ দিয়ে অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা ফা-তু-জো খালেক মিলা (জোহরা মিলা) বলেছেন, সাপ কামড়ালে ওঝার কাছে না গিয়ে দ্রæত নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সম্ভব হলে যে সাপ দংশন করেছে, তা চিহ্নিত করার জন্য সেই সাপের ছবি তুলে স্থানীয় বন কর্মকর্তা ও চিকিৎসককে দেখানোর পরামর্শও দেন তিনি।
চিকিৎকদের মতে, রাসেলস ভাইপার কামড়ালে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। তা ছাড়া রাসেলস ভাইপারের দংশনের পর চিকিৎসা নিতে দেরি হলে রোগী মারা যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে শক, পেশি প্যারালিসিস, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তক্ষরণ এবং কিডনি অথবা রেনাল ফেইলিওর।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক মোহাম্মদ হাসান তারিক বলেন, রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার ব্যক্তির কিডনি দ্রæত অকেজো হতে শুরু করে। শরীর জ্বালাপোড়া করার পাশাপাশি দংশনের স্থানে পচন ধরে। একই সঙ্গে দংশনের শিকার ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। এসব ক্ষেত্রে দ্রæত চিকিৎসা দেওয়া না হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম থাকলেও সেটা খুব একটা কাজ করে না। ২০১৫ সালের দিকে আমরা প্রথম রাসেলস ভাইপারে কামড়ানো রোগী পেয়েছিলাম। সে সময় আক্রান্ত হাত-পা কেটে ফেলেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তাই সাপটির কবল থেকে বাঁচতে সচেতনতাই কার্যকর পথ।
সাপে কামড়ালে করণীয় : সাপে কামড়ালে রোগীকে প্রথমেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে। সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় কামড় খেয়ে আতঙ্কিত হওয়ার ফলে। তাই রোগীকে একেবারেই আতঙ্কিত হতে দেওয়া যাবে না, শান্ত রাখতে হবে। সাপের কামড়ের স্থানটি যথাসম্ভব নড়াচড়া না করানোর চেষ্টা করতে হবে।
সাপে কামড়ানো জায়গা তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার ব্যান্ডেজ বা সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে ধুলাবালি না লাগে। হাতের কোনো অংশে সাপে কাটলে সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ি, ব্রেসলেট, আংটি ইত্যাদি খুলে ফেলতে হবে। কাপড় ঢিলেঢালা করে দিতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে শুইয়ে দিতে হবে। তবে সাপে কামড়ানো ব্যক্তিকে কখনোই কাত করে শোয়ানো যাবে না। সব সময় সোজা করে শোয়াতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির বুকের নিচে কিছু একটা দিয়ে বুকটা উঁচু করে রাখতে হবে, যাতে আক্রান্ত স্থানটি হার্ট লেভেলের নিচে থাকে।
বিষাক্ত সাপের কামড়ে দুটি দাঁত বসে গিয়ে ক্ষত তৈরি হয়। বিষহীন সাপের কামড়ে অনেকগুলো দাঁতের আঁচড় পড়তে পারে। তাই কামড় দেখে বুঝতে হবে যে এটি বিষাক্ত সাপে কামড়েছে নাকি বিষহীন সাপে কামড়েছে। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিষাক্ত সাপের কামড়ে ক্ষতস্থান জ্বালাপোড়া করে। সম্ভব হলে সাপটি দেখতে কেমন তা লক্ষ্য করতে হবে। সাপের বর্ণনা পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা পরিকল্পনায় সাহায্য করতে পারে। কামড় দেখে শনাক্ত করতে ক্ষতস্থান রক্তাক্ত থাকলে আগে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
সাপে কামড়ালে আক্রান্ত স্থান থেকে বিষ চুষে বের করার চেষ্টা করা মোটেও ঠিক নয়। আক্রান্ত জায়গায় কোনো ধরনের ওষুধ বা কেমিক্যাল ব্যবহার করা ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাপ যেখানে কামড় দিয়েছে, সেখানে কেটে রক্ত বের করার চেষ্টা করা হয়। এতে আশপাশের রক্ত সংবহনতন্ত্র বা স্নায়ুতন্ত্র কেটে যেতে পারে।
সাপে কামড়ালে ওঝার কাছে না গিয়ে দ্রæত হাসপাতালে যেতে হবে। বিষাক্ত সাপে কাটলে বাঁচার পথ একটাই। দ্রæত হাসপাতাল যাওয়া। দংশনের পর আত্মীয়ের পরামর্শ, ওঝা-ঝাড়ফুঁকের নামে এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে সোজা রোগীকে নিয়ে বড় সরকারি হাসপাতালে যেতে হবে।
কৃষিজমিতে কাজের সময় অবশ্যই গামবুট পরতে হবে। সম্ভব হলে হাতে গøাভস পরতে হবে। সাপ হাত এবং পায়ে দংশন করে সবচেয়ে বেশি। রাতের বেলা লাইট নিয়ে চলাফেরা করতে হবে। রাতে জমিতে কাজ না করাই ভালো। জমির ধান, ভুট্টাসহ নানা ফসল কাটার জন্য যান্ত্রিক মেশিন ব্যবহার করা ভালো।
জমি এবং জমির ঝোপঝাড় দিয়ে হাঁটার সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। রাসেলস ভাইপার হিসহিস শব্দ করে। যা কানে বেশ জোরে শোনা যায়। এ কারণে হিসহিস শব্দ শুনলে সাবধান হতে হবে। কাজ করার সময় মাটিতে শব্দ করা যেতে পারে, যাতে সামান্য হলেও কম্পন সৃষ্টি হয়। রাসেলস ভাইপার কম্পন বুঝতে পারে। রাসেলস ভাইপার দ্রæত দংশন করতে পারে।